দেওয়ানগঞ্জপ্রধান খবর

কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, রোপা-আমন চাষে লোকসানের আশঙ্কা কৃষকের

মহসিন রেজা রুমেল,দেওয়ানগঞ্জ:  হঠাৎ কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার হাজারো চাষী। চাষাবাদ করে আগের মতো পুষিয়ে উঠতে পারবেন কিনা এ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে। সার-বীজ ও শ্রমিকের চড়া মূল্যে দিশেহারা এ অঞ্চলের অধিকাংশ চাষী। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রোপা-আমন চাষ করে এবার লাভের বদলে লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা।

বর্তমানে এ অঞ্চলে রোপা আমন ধানের চারাবীজ রোপনের মৌসুম চলছে। বর্ষা মৌসুম শেষে রোপা আমন চাষ হয় বলে এতে অধিকত্ব বন্যার ঝুঁকি থাকে। বেশিরভাগ সময়ই কৃষকের লাগানো রোপা আমন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এবছর বন্যার খুব বেশি সম্ভাবনা না থাকায় রোপা আমন চাষে ঝুকেছেন এ অঞ্চলের অধিকাংশ চাষিরা। আর এ সুযোগে এবার হাইব্রিড ধানবীজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের ধানের বীজতলা নেই তারা চড়া দরে রোপা আমনের চারাবীজ ক্রয় করে রোপন করছেন। বর্তমানে রোপা আমন চারাবীজের মূল্য বেড়েছে। সারের দাম বেশি। বেড়েছে ডিজেলের দামও।

এ অঞ্চলের কয়েকজন চাষির সাথে কথা হলে তারা জানান, চালসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি পায়নি ধানের বাজার। গত বছর এ মৌসুমে বাজারে প্রতিমণ ধান বেচা কেনা হতো ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। চলতি বছর তা অপরিবর্তিত রয়েছে। এ অঞ্চলে এক বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৫ মণ রোপা আমন ধান ফলে। প্রতিমণ ধান ১ হাজার ৩০০ টাকায় বেচাকেনা হলে গড় উৎপাদন ১২.৫ মণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২৫০ টাকা। এক বিঘা জমিতে ধান চাষে মোট ব্যয় হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। সে হিসেবে রোপা আমন চাষ করে একজন কৃষক নীট মুনাফা পাচ্ছেন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এর মধ্যে রয়েছে নিজের শ্রমের মজুরী।

তাঁরা জানান, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রোপা আমন চাষে এখন আর নেই আগের মতো মুনাফা।

পাঁচ বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষ করেছেন ডিগ্রীরচরের শেখ তালেব। তাতে আগে মোট ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এবছর তিন বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষ করতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার টাকা। আগে বছর শেষে অবশিষ্ট না থাকলেও খাওয়া-পড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবাদের ধানে সারা বছর সংসার চলেছে। কিন্তু এবার রোপা আমন চাষ করে ব্যয় পুষিয়ে লাভ দেখা কঠিন।

সদর ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামের চাষি লোকমান হোসেন বলেন- বর্ষার শেষে জমি ভেজা থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। এই সময়টাতে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। আগে রোপা আমন চাষে বিঘাপ্রতি খরচ যেত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর বর্তমানে কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে রোপা আমন চাষে বিঘাপ্রতি ব্যয় হচ্ছে আট থেকে দশ হাজার টাকা।

চাষীরা জানান- গত বছর রোপা আমন মৌসুমে প্রতি শ্রমিকের মজুরি ছিল  ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে এ বছর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে প্রতি শ্রমিকের মজুরি হয়েছে ৭০০ টাকা। বীজ তলায় চারা বীজ উৎপাদনের শুরুর দিকে প্রতি কেজি ধানবীজ প্যাকেটের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৪৪০ টাকা। কিন্তু চলতি বছর তা বিক্রি হয়েছে ৪৭০ থেকে ৫৮০ টাকায়। সেই কারণে প্রতি বিঘা রোপা আমনের ছোট চারা বীজের দাম চলতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর প্রতি বিঘা রোপা আমনের ছোট চারাবীজের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি বছর ৫০০ বেড়ে তা হয়েছে ২ হাজার টাকা।

সরকার নির্ধারিত সারের মূল্য ইউরিয়া প্রতি বস্তা ১ হাজার ৩৫০, মিউরিয়েট অব পটাশ ১ হাজার, ডিএপি ১ হাজার ৫০ এবং টিএসপি ১ হাজার ৩৫০ টাকা। তার মধ্যে ইউরিয়া সার সরকার নির্ধারিত মূল্যে খুচরা ও পাইকারী বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান বাজারে টিএসপি সারের যোগান নেই। কিন্তু মিউরিয়েট অব পটাশ (এমওপি) খুরচা বাজারে ১ হাজার ৩২০ এবং ডিএপি ১ হাজার ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ উপজেলায় ২১ জন বিসিআইসির অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়- বিসিআইসির সার ডিলারগণ সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি করছেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের খুরচা ব্যবসায়িরা এমওপি ও ডিএপি সারের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে স্থানীয় ভাবে সিন্ডিকেট করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বেশি দরে বিক্রি করছেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত সারের বাজার মনিটরিং করছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন মিয়া বলেন, দেওয়ানগঞ্জে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। ইতোমধ্যে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী যেন সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি বা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করতে না পারে , সেজন্য নিয়মিত সারের বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে- এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান, পাট, ভূট্টা ও আখ। এর মধ্যে বেশির ভাগ চাষীদের খাদ্যের যোগান দেয় ধান। চলতি রোপা আমন মৌসুমে ৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪ হাজার ৯৮০ হেক্টর রোপা আমন লাগানো হয়েছে। বাকি জমিতে সেপ্টেম্বরের প্রথম পক্ষের মধ্যে লাগানো শেষ হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে- দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৫২ হাজার ৮৬১ কৃষক পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে বড় কৃষক পরিবার ৫০, মাঝারি কৃষক পরিবার ২ হাজার ২২৫ হাজার। ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার ২২ হাজার ৫১১ হাজার। ভূমিহীন কৃষক পরিবার ২ হাজার ৪৮৫ এবং প্রান্তিক কৃষক পরিবার রয়েছে ২৫ হাজার ৫৯০ টি।

Related Articles

Back to top button