বিশেষ সংবাদ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: লোভ আর দুর্নীতিতে যেটির পতন হয়েছিল

নন্দকুমারকে জালিয়াতির অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তার প্রকৃত অপরাধ ছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা।

সেই অভিযোগের কারণে হেস্টিংসের বিচারক বন্ধু ব্রিটিশ আইন প্রয়োগ করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। যদিও ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতে। সেখানে ব্রিটিশ আইন কার্যকর হওয়ার কথাই ছিল না।

১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের মৃত্যুর পরে যাদের ভারতে ব্যবসা করতে অনুমতি নিতে হতো, সেই মুঘল সম্রাজ্যের পতনের পর তারা ভারতের অঘোষিত শাসক হয়ে দাঁড়ায়।

আঠারো শতকের শুরু থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করে। সেই সাথে কোম্পানির ভেতরে দুর্নীতি, লোভ ও অব্যবস্থাপনাও ছড়িয়ে পড়ে।

ফলশ্রুতিতে বিচারহীনতা, ক্ষমতার লোভ, ষড়যন্ত্র বাড়তেই থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, নন্দকুমারকে ‘বিচারিক খুন’ করা হয়েছিল।

হেনরি বেভারিজ তার ‘দ্য ট্রায়াল অফ মহারাজা নন্দ কুমার: আ ন্যারেটিভ অফ আ জুডিশিয়াল মার্ডার’ বইতে ‘প্রমাণ’ সহ লিখেছেন যে, যেই নথিটি জাল বলা হয়েছিল, তা আসল দলিল ছিল এবং অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি।

মামলাটি প্রস্তুতির আগে রাষ্ট্রপক্ষ এটিকে জাল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকী তথ্যপ্রমাণও রয়েছে যে মামলাটি স্বয়ং হেস্টিংসই করেছিলেন।

তিনি সাক্ষ্যগুলোকে ‘সন্দেহজনক’ উল্লেখ করে বলেছেন, ওই বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। বিচারপতি এলিজা ইম্পি ছিলেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ভূমিকা ছিলও ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’।

তিনি লিখেছেন, ওই বিচারক প্যানেলে আরো তারা ছিলেন অযোগ্য ও পক্ষপাতদুষ্ট। নন্দ কুমারকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্রের ফল।

বইয়ের শেষ অংশে বেভারিজ একটি চিঠি উদ্ধৃত করেছেন; যেখানে নন্দকুমারের ফাঁসির দুই দিন পর ফ্রান্সিস নামে এক কর্মকর্তা লিখছেন, “নন্দকুমারকে সাত-আট বছর আগের একটি জালিয়াতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। পুরো সময় তিনি ছিলেন দৃঢ়, শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী।”

ওই চিঠিতে আরও লেখা হয়, “সে (নন্দকুমার) অপরাধী ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এখানে কারো সন্দেহ নেই যে, যদি সে রাজনীতিতে জড়িয়ে না পড়ত, তাহলে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগই উঠতো না।”

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং প্রথম কর্পোরেশন কোম্পানি।

১৬০০ সালের ৩১শে জুলাই, স্যার থমাস স্মাইথের নেতৃত্বে লন্ডনের একদল ব্যবসায়ী রানি প্রথম এলিজাবেথের কাছে একটি আর্জি নিয়ে হাজির হন।

তারা রানির কাছে পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য রানির সম্মতি ও রাজসনদ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন।

রানি প্রথম এলিজাবেথ তাদের সম্মতি দেন। পরবর্তীতে ৭০ হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়।

রানি এলিজাবেথ যখন লন্ডনের বণিকদের দেওয়া অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করেন, তখন ভারতের শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর।

শুরুতে মুঘল শাসকরা এই ইংরেজ ব্যবসায়ীদের স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং উভয় পক্ষই বাণিজ্যের সুবিধা দেখতে পেয়েছিল। ১৬৬৮ সালের মধ্যে তারা ভারতের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, বিশেষ করে মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলকাতায়। বাণিজ্য প্রসারে তারা এসব জায়গায় কারখানাও স্থাপন করেছিল।

কিন্তু শতাব্দির শেষদিকে এসে কোম্পানির সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যখন তাদের বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাখ্যান করা হয়, তখন কোম্পানি তার বন্দরগুলো বন্ধ করে দেয়। তখন মুঘলদের সাথে কোম্পানির যুদ্ধ শুরু হয়, যে যুদ্ধ অ্যাংলো-মুঘল যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল।

এই যুদ্ধে সম্রাট আওরঙ্গজেব ব্রিটিশদের পরাজিত করেন। পরে তিনি চিন্তা করলেন, বৃটিশ বণিকরা কোন বড় হুমকির কারণ হবে না। যে কারণে যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের জরিমানা ও ক্ষমা করে বিষয়টির মীমাংসা করেন।

কিন্তু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। আর এই সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ক্ষমতা ও অর্থ সংগ্রহ বাড়াতে শুরু করে। তারা প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনের পর ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসকেও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করে।

ব্রিটেনের জাতীয় সেনা জাদুঘর রবার্ট ক্লাইভকে ‘নবাব জেনারেল’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও চতুর সামরিক কমান্ডার। যিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

রবার্ট ক্লাইভ নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারের জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ও আমিচাঁদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঘুষও প্রদান করেছিলেন। এমনকি সেনাপতি মীর জাফরকেও কিনে নিয়েছিলেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন খুব সহজেই পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয় ব্রিটিশরা।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ পি. ই. রবার্টস লিখেছেন, “এটি প্রকৃত কোনো যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি ধোঁকাবাজির খেলা”।

১৭শ এবং ১৮শ শতাব্দীতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দাস ব্যবসার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

ব্রায়ান ডোইনানের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার গবেষণায় দেখা যায়, ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় একটি অদৃশ্য পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে।

ওই সরকারের অব্যবস্থাপনায় ১৭৭০ সালে বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে বাংলার ভূমি রাজস্ব মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেউলিয়া হতে শুরু করে।

ব্রিটেনের ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়ামের তথ্যমতে, রবার্ট ক্লাইভ একজন লোভী বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যিনি নিজের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন।

১৭৫৮ থেকে ১৭৬০ এবং ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৭ সালে রবার্ট ক্লাইভ দুই দফায় বাংলার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর প্রথম মেয়াদে বাংলায় ব্যাপক লুটপাট চলতে থাকে।যখন তিনি ব্রিটেনে ফিরে যান, তখন পার্লামেন্টে তাঁকে এক দুর্নীতিগ্রস্ত ‘নবাব’ আখ্যা দিয়ে তীব্র ভৎসনা করা হয়।

যদিও তিনি পরবর্তীতে বাংলার শাসন ব্যবস্থার সংস্কার ও দুর্নীতি হ্রাস করার চেষ্টা করেছিলেন।

১৭৬৭ সালে তিনি যখন আবার ব্রিটেনে ফিরে যান তখন আবারো তাকে নতুন করে রাজনৈতিক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

জেনারেল জন বার্গোয়েন, এডমন্ড বার্ক এবং অন্য পার্লামেন্ট সদস্যরা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। এর জবাবে ক্লাইভ তখন আত্নপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন, “আমার সহনশীলতায় আমি নিজেই বিস্মিত”।

যদিও পরে পার্লামেন্ট তার পক্ষ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছিলেন। পরে অসুস্থতা ও মানসিক অবসাদগ্রস্থ অবস্থায় ১৭৭৪ সালের ২৪শে নভেম্বর তিনি মারা যান। ধারণা করা হয় তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

মৃত্যুকালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক পাঁচ লাখ পাউন্ড ছিল। বর্তমান বাজারে যা ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ডের সমান।

ক্লাইভের আয় বছরে দুই লাখ ৩৪ হাজার ইউরো

ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র দত্ত তার ‘দ্যা ইকনোমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া আন্ডার আর্লি ব্রিটিশ রুল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘কোম্পানির কর্মকর্তারা প্রথমত এসেছিলেন অর্থ উপার্জন করতে পরে রাজত্ব করতে’।

এই বইয়ের তথ্য মতে, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি যেন তখন কোম্পানি ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।

থমাস ম্যাকলে লেখেন, “ক্লাইভ তার সম্পদ বানিয়েছিলেন কোনো ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, বরং বিজয়ী ও রাজাদের প্রভু হিসেবে।”

রমেশ চন্দ্র দত্তের মতে, ১৭৬৫ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি বছর গড়ে তিন মিলিয়ন পাউন্ড বাংলা থেকে ব্রিটেনে স্থানান্তর করেছিলেন। যা ছিল মোট রাজস্বের প্রায় ২৫ শতাংশ। এই সম্পদ পাচার স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।

ব্রায়ান ডোইনান তার বইয়ে লিখেন, ১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জরুরি ভিত্তিতে ঋণ চাইলে ব্রিটিশ সরকার তখন এক মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ সহায়তা প্রদান করে।

সম্পদ পাচারসহ এসব কারণে তখন কোম্পানি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিভিন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তা সরকারি নজরদারিতেও আনা হয়।

প্রথমে ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং পরে ১৭৮৪ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতবিষয়ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করে।

ডোইনানের মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। ১৮০০ সালের মধ্যে বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখে। যা ছিল সে সময়কার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরও দ্বিগুণ।

এই সৈন্য বাহিনী ব্যবহার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় রাজ্য এবং রাজবংশের ওপর দমন পীড়ন চালায়।

যে বাহিনী শুরুতে শুধুমাত্র বাণিজ্য করতে এসেছিল, তারাই এক পর্যায়ে সৈন্য বাহিনী ব্যবহার করে নিপীড়নমূলক আচরণ শুরু করে। সৈন্য বাহিনীকে ব্যবহার করে জোরপূর্বক কর আদায় করে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাট এবং দক্ষ ও অদক্ষ ভারতীয় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক শোষণও করে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপ, বিশেষ করে এর কর্মচারীদের আচরণ, ব্রিটেনে তীব্র জনরোষের সৃষ্টি করেছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যেসব কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত, বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য উপায়ে প্রচুর ধনী হয়েছিলেন তারা ‘নবাব’ নামেই পরিচিত ছিল।

আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এই ব্যক্তিরা, তাদের এজেন্ট এবং ঘুষখোররা, ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করবে এবং সেখানে একটি অজেয় ‘পূর্ব ভারতীয় স্বার্থ’ প্রতিষ্ঠা করবে।’

কোম্পানির দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে তখন ব্যাপক হতাশা দেখা দেয়। বিশেষ করে ১৭৭২ সালে, যখন কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়ে তখন লর্ড নর্থ ১৭৭৩ সালে “রেগুলেটিং অ্যাক্ট” পাস করেন। তখন কোম্পানির অনেক কর্মকর্তার দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ নিয়ে তীব্র সমালোচনাও দেখা যায়।

পলাশীর বিজয়ী রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬১ সাল থেকে শ্রেসবারির সংসদ সদস্য ছিলেন।

১৭৭৩ সালের মে মাসে যখন প্রেস্টনের এমপি জেনারেল জন বারগয়েন তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনেন, তখন ক্লাইভকে টানা তিন দিন পার্লামেন্টে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্যও রাখতে হয়।

ম্যালটনের এমপি এডমন্ড বার্ক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি ও নৈতিক অধঃপতনের কড়া সমালোচক হয়ে ওঠেন। তিনি প্রাক্তন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৭৩–১৭৮৫) বিরুদ্ধে অপশাসন ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিশংসনের দাবি তোলেন এবং এর জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচারণাও চালান।

হেস্টিংসকে ১৭৮৭ সালে অভিশংসিত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে “গুরুতর অপরাধ ও দুষ্কর্মের” অভিযোগ আনা হয়। যার মধ্যে নন্দকুমারের বিচার ছিল অন্যতম।

এই বিচার ১৭৮৮ সালে ওয়েস্টমিনস্টার হলে শুরু হয় এবং এটি পার্লামেন্টে সংসদীয় ইতিহাসে দীর্ঘতম অভিশংসন বিচার হিসেবে পরিলক্ষিত হয়।

বার্ক হেস্টিংসকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন, তাঁকে ‘পাপের সেনাপতি’, ‘নরকের মাকড়সা’ এবং ‘লাশ খোঁচানো শকুন’ বলেও আখ্যা দেন।

কিন্তু সব যুক্তি সত্ত্বেও ১৭৯৫ সালের এপ্রিলে হেস্টিংসকে খালাস দেওয়া হয়।

ক্লাইভ ও হেস্টিংসের বিরুদ্ধে এই বিচারগুলো নিয়ে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। এই সময়ে ইভানজেলিকাল আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ জনসাধারণের মধ্যে এই ধারণা বাড়তে থাকে যে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন নৈতিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত।

কিন্তু ডোয়নানের মতে, উনিশ শতকের শুরু থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনে অবৈধভাবে আফিম বিক্রি শুরু করে, যাতে তারা ভারতীয় চা ও অন্যান্য পণ্যের ক্রয়ের অর্থ জোগাড় করতে পারে।

এই বাণিজ্য নিয়ে চীনা বিরোধিতার ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২) এবং (১৮৫৬-৬০) সংঘটিত হয়, যার উভয় যুদ্ধেই ব্রিটিশরা জয়লাভ করে।

১৮১৩ এবং ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে চীন ও ভারতের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটে। এরপর অন্যান্য ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে শুরু করে। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে কেবলমাত্র একটি প্রতীকী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

পার্সিভাল স্পিয়ার তাঁর বই ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’তে লিখেছেন, উনিশ শতকের মধ্যভাগে এসে কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার গুরুত্বও হারিয়ে ফেলে।

১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ভারতে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ নামেই পরিচিত ছিল। যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য একটি মোড় ঘোরানো ঘটনাও ছিল।

এটি শুরু হয়েছিল কোম্পানির নিজস্ব ভারতীয় সিপাহীদের নেতৃত্বে। যারা তাদের ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। দ্রুতই এই আন্দোলন জনসমর্থন পায় এবং তা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।

এই বিদ্রোহের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে কোম্পানির সরকার থেকে অপসারণ ঘটে। পরে, ২৭৪ বছরের বাণিজ্য ইতিহাসের অবসান ঘটিয়ে পহেলা জুন ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।

ইতিহাসবিদ মার্ক কার্টরাইট লিখেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিজেই দায়ী। এর অবসান ঘটে প্রধানত ভারতে চরম দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে।

ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল ডাউন টু আর্থ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুটপাট, দুর্নীতি এবং সম্পদ চুরি সম্পর্কে ব্রিটেনের স্বীকারোক্তি জরুরি। একইসাথে ভারতীয়দেরও এটি বুঝতে হবে যে এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সহযোগিতাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।”

জগৎ শেঠ এবং হিন্দু ব্যাংকাররা কোম্পানিকে সমর্থন করেছিল। বাংলার ধনী শ্রেণি মুঘলদের সম্পত্তি কিনেছিলেন। দেব, মালিক এবং ঠাকুর পরিবার এই সম্পত্তির সুযোগ নেয় এবং কোম্পানির ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্তরা কোম্পানির বন্ড কিনে এতে বিনিয়োগ করে। এসব কারণ ছাড়া সম্ভবত কোম্পানি সফল হতো না।

Back to top button