যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে ব্যর্থতার অভিযোগ, আলোচকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
পহেলা অগাস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই বার্তা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাঠানো ওই চিঠিতে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তার কারণও ব্যাখ্যা করেছে ওয়াশিংটন।
একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজার খোলা এবং শুল্ক ও অশুল্ক নীতিমালাসহ বাণিজ্য বাধা দূর করলে কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার কথাও বলা হয়েছে ওই চিঠিতে।
এদিকে বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্ক আরোপের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি, বিশেষ করে দেশের বৃহৎ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে এর প্রভাব কতটা পড়বে তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ।
শুল্ক ইস্যুতে আলোচনার জন্য বাণিজ্য উপদেষ্টা নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এখনো ওয়াশিংটন সফরে রয়েছে এবং নয়ই জুলাই মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের আরেক দফা আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
যদিও পরিস্থিতি বিবেচনায় এই আলোচনা কতটা ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অর্থনীতিবিদদের অনেকের মধ্যে। তারা বলছেন–– চিঠি ইস্যু হয়ে গেছে ও তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে, সেখানে আলোচনা করে আর কী ফলাফল পাওয়া যাবে?
তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আরও আলোচনা উচিত ছিল। তবে “নন ডিসক্লোজার ক্লজ দেয়ার কারণে কী আলোচনা হচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা জানি না”।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে আলোচকদের ‘যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় “বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিচ্ছে বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর করেই যাদের ব্যবসা, তাদের “পথে বসাবে” এই সিদ্ধান্ত।
গত এপ্রিলে বিভিন্ন দেশের ওপর রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাম্প প্রশাসন, যেখানে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানানো হয়।
যা নয়ই এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছিল। তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এসব শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রসঙ্গত, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ।
চিঠিতে যে বার্তা দিয়েছেন ট্রাম্প
নতুন শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে ১৪টি দেশের নেতাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেসব চিঠি তিনি নিজের ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছেও একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যেখানে পহেলা অগাস্ট থেকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “দুঃখজনকভাবে, আমাদের সম্পর্কটি বর্তমানে সমতা থেকে অনেক দূরে।তাই, পহেলা অগাস্ট ২০২৫ থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশি যেকোনো এবং সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবো।”
“এই শুল্ক এড়াতে যদি ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হয়, সেটিও উচ্চ শুল্কের আওতায় পড়বে”।
“তবে বাংলাদেশ বা আপনার দেশের কোম্পানিগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য উৎপাদন বা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না,” উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
এক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশ যদিও শুল্ক হার বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা হারে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবে।
শুল্কের হার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে বলেও জানানো হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই চিঠিতে।
ওয়াশিংটন বলছেন, “যদি আপনি এতদিন ধরে বন্ধ থাকা বাণিজ্য বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুলতে চান এবং আপনার শুল্ক ও অশুল্ক নীতিমালা এবং বাণিজ্য বাধাগুলো দূর করতে চান, তাহলে আমরা এই চিঠির কিছু অংশ পুনর্বিবেচনা করতে পারি।”
মার্কিন শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশে নানা হিসাব-নিকাশ
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ, যা ইউএসটিআর নামে পরিচিত, তাদের হিসাবে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক এক হাজার ৬০ কোটি ডলার।
ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে বাংলাদেশে। যার বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের মতো।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে–– কৃষিপণ্য যেমন, খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম ও ভুট্টা। এছাড়া যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাতজাত পণ্যও আসে বাংলাদেশে।
আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে–– তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত ‘অযৌক্তিক শুল্ক’ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলবে।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য রপ্তানির উল্লেখযোগ্য গন্তব্য হওয়ায় সব পণ্য নিয়েই চিন্তা রয়েছে। তবে পোশাক খাত নিয়েই দুঃশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি।
এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে আঘাত হানবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দাম বেড়ে যাবে, যাতে স্থানীয় চাহিদা কমে আমদানি চাহিদাও কমাবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলছেন, মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
“ওভারঅল একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হবে। আর যারা ঠু মাচ ডিপেন্ড অন ইউএস মার্কেট (যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল), তারা অলমোস্ট দেউলিয়া হয়ে যাবে,” বলেন মি. বাবু।
তিনি বলছেন, অগাস্টের এক তারিখ পর্যন্ত সময় থাকায় সরকার এখনো আলোচনার কথা বলছে, “দেখা যাক কী হয়”।
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের উদাহরণ টানছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। কারণ দরকষাকষির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০ শতাংশ শুল্ক চুক্তি করেছে দেশটি।
ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি-রপ্তানির বাজার অনেক বিস্তৃত হলেও অন্তত তাদের সমপরিমাণ শুল্কও যদি বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে তাহলেও “আমাদের বাণিজ্য স্বার্থ কিছুটা রক্ষা হতে পারে” বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
এক্ষেত্রে অবশ্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও’র সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সংস্থাটির নীতিমালায় ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করেন ড. রহমান।
কারণ ডব্লিউটিও’র নীতি অনুযায়ী “ফেভার ওয়ান ফেভার অল” সুবিধা দিতে হয়। ফলে কোনো দেশকে শুল্ক সুবিধা নিয়ে বাড়তি সুযোগ দেওয়া যাবে না। “যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি নাও করতে পারে,” বলেন তিনি।
ট্যারিফ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলছেন, “সরকারের কথাবার্তায় গোছালো প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয়নি।”
এছাড়া তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “যাদের দিয়ে নেগোসিয়েশন করানো হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, তারা কি আসলে সেই যোগ্যতা রাখেন সবাই?”
সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা.