স্বামীহারা বাকপ্রতিবন্ধী মায়ের কান্না
শুনতে পারেন না, বলতে পারেন না—তবু ছেলেকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা মহিমার

রৌমারী(কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: নির্জন সীমান্তঘেঁষা এক পল্লীগ্রামে-কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ছাট কড়াইবাড়ি গ্রামে—অবস্থিত এক নিঃসঙ্গ, নির্যাতিত, অবহেলিত প্রাণের নাম মহিমা খাতুন (৪৫)। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এই নারীর জীবনের প্রতিটি দিন যেন এক অসমাপ্ত কষ্টগাঁথার পাতা। উন্নয়নের জয়গান যখন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ধ্বনিত হচ্ছে, তখনও মহিমা বেঁচে আছেন সমাজের নির্লজ্জ অবহেলা আর অদৃশ্য নিষ্ঠুরতার মাঝে।
স্বামীহীন এই নারীর একমাত্র ভরসা-প্রতিবন্ধী ভাতা, যা মাসে মাত্র ৮৫০ টাকা। এই সামান্য টাকায় একদিনের খাবার জোটে কি না সন্দেহ, মাসের খরচ চালানো তো দূরের কথা। দুই বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। পরনে পুরোনো শাড়ি, মাথার ওপর ছেঁড়া চাল, মাটির ভাঙাচোরা মেঝেতে রাত পার করেন তিনি ও তার সাত বছরের সন্তান মমিন বাদশাহ। নেই নিজের কোনো জমি, বাড়ি, বা একফালি ঠাঁই-বৃষ্টির দিনে পানি পড়ে, গরমে দম আটকে আসে, শীতকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কষ্টে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না।
জীবনের শুরুটা ছিলো শান্ত, একটুখানি সুখ-স্মৃতিও ছিলো। প্রায় ১৪ বছর আগে গুটলি গ্রামের মহিমার বিয়ে হয় দিনমজুর শফিয়ার রহমানের সঙ্গে। কষ্টের সংসার হলেও ভালোবাসার টানে দিন কেটে যাচ্ছিল। বিয়ের দুই বছরের মাথায় জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান মমিন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সঙ্গী হয়নি। হঠাৎ একদিন শফিয়ার অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপরই যেন থমকে যায় মহিমার পৃথিবী। একা, অসহায়, প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেন তিনি।
বলতে পারেন না, শুনতেও পান না। নিজের প্রয়োজন বোঝাতে গিয়ে ইশারায় হিমশিম খান মহিমা। তার চোখে প্রতিদিন অজানা আতঙ্ক-আজকের খাবার কোথা থেকে আসবে? ছেলেটা স্কুলে যাবে কীভাবে? একটু চিকিৎসা, একটু নিরাপত্তা, একটু ভালো থাকার আশ্বাস-সবই যেন দুঃস্বপ্নের মতো দূরে।
এই অসহায় মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার দেবর আব্দুল বাতেন ও ভাতিজা বাবুল, যাঁরাও নিজ নিজ পরিবার চালাতে গিয়ে হিমশিম খান। তবুও, মানবিক দায়িত্ব থেকে তারা যতটুকু পারেন, দিয়ে যান মহিমাকে।
মহিমার স্বজন আব্দুল বাতেন বলেন, “আমরা নিজেরাও অনেক কষ্টে থাকি, কিন্তু ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী আর এতিম ছেলেটাকে ফেলে রাখার মতো পাষাণ হইনি। যতটুকু পারি, চেষ্টা করি পাশে থাকতে। কিন্তু আমাদের সাহায্য তো একবেলার খাবারেই ফুরায়।”
ছোট্ট মমিনের স্বপ্ন খুব সাদামাটা—স্কুলে যেতে চায়, নতুন জামা চাই, পেটভরে ভাত খেতে চায়। অথচ প্রতিদিনই তার মা খালি হাতে ঘরে ফিরে এসে তাকে বোঝান—না পারতে ইশারায়, না পারলে চোখের জলেই।
এই নিঃস্ব পরিবারটির এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি নিরাপদ ঠাঁই, ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা, শিশুটির লেখাপড়ার নিশ্চয়তা এবং একটি মানবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহলের দাবি—সরকারি পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় এনে মহিমাকে একটি ঘর, একটি ভাতার নিশ্চয়তা ও তার ছেলের শিক্ষাজীবন বাঁচিয়ে তোলা হোক। সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।
আশ্বাস দিয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শামসুদ্দিন বলেন—“আমরা তার ঘর তোলার জন্য সহযোগিতা করব।”
এসব বিষয়ে রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন, “প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব, মহিমার পাশে দাঁড়ানো হবে। তার ছেলেটির ভবিষ্যত যেন অন্ধকারে ডুবে না যায়, সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট থাকব।”
মহিমার জীবন যেন এক নীরব আর্তনাদ—যার শব্দ আমাদের কানে পৌঁছায় না, তবে অনুভব করা যায় হৃদয়ে। এই মুহূর্তে আমাদের সকলের দায়িত্ব—এই নীরব চিৎকারের জবাব দেওয়া। কারণ, মানুষ শুধু উন্নয়ন নয়, মানবতা দিয়েও পরিমাপ হয়।




