সড়কের নিচে চাপা পড়ে আছে ছয় শহীদের কবর
এম আর সাইফুল,মাদারগঞ্জ: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের নগর বধ্যভূমি আজ অরক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। অযত্ন, অবহেলা ও রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি অস্তিত্ব হারানোর মুখে।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে উপজেলার নগরগ্রামের ছয়জন নিরীহ গ্রামবাসী নির্মমভাবে নিহত হন।
শহীদরা হলেন- মেছের আলী, আব্দুল গনি, আব্দুল কদ্দুছ, নুর হোসেন, ঘোতা মিয়া ও ভোলা মিয়া।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী- সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল সরিষাবাড়ীর ভাটারা এলাকা থেকে মাদারগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কয়েকটি জিপে করে আসার পথে ভুলবশত তারা নগর গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী যুবক মেছের আলী একটি জিপ লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।
এই নৃশংসতার প্রতিবাদ জানালে সাহসী যুবক আব্দুল গনি, আব্দুল কদ্দুছ, নুর হোসেন, ঘোতা মিয়া ও ভোলা মিয়াকে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে তারা ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন। আকস্মিক এ হত্যাযজ্ঞে আতঙ্কিত হয়ে গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে পালিয়ে যান। পাক সেনারা চলে যাওয়ার আগে নগর গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটপাট চালায়।
ঘটনার দুই থেকে তিন দিন পর আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাশের একটি ডোবা থেকে ছয় শহীদের মরদেহ উদ্ধার করে সড়কের পাশে দাফন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন সংসদ সদস্য করিমুজ্জামান তালুকদারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এটিকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৯১ সালের দিকে আদারভিটা-কালিবাড়ী গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের সময় বধ্যভূমির ওপর দিয়ে রাস্তা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও শহীদ পরিবারের বাধা সত্ত্বেও কাজ চলতে থাকে এবং একপর্যায়ে বধ্যভূমিটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে এলজিইডি সড়কটি পাকাকরণ করলে ছয় শহীদের কবর স্থায়ীভাবে সড়কের নিচে চাপা পড়ে যায়। ফলে চিহ্নিত বধ্যভূমিটি আজও মর্যাদাহীন ও অচিহ্নিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোসাদ্দেক আলী বলেন- “১৯৭১ সালের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী নগর গ্রামের এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে দ্রুত সরকারি উদ্যোগে এটি সংরক্ষণ করা জরুরি।”
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন- “মাদারগঞ্জের একমাত্র বধ্যভূমি এটি। ৫৪ বছরেও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শহীদদের কবরের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ জাতির জন্য লজ্জাজনক। দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।”
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী জানান- তিনি সদ্য যোগদান করায় বিষয়টি সম্পর্কে আগে অবগত ছিলেন না। তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনা করে বধ্যভূমির সীমানা চিহ্নিত করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।
শহীদ পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি-ছয় শহীদের কবর সংরক্ষণ, তাদের নামে সড়ক ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মাদারগঞ্জ গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। ইতিহাসের দায় মেটাতে এখনই প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ।




