প্রধান খবরআন্তর্জাতিক

‘বাবা-মাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি,’ তেহরানে পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত বিবিসির সাংবাদিক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বাসিন্দাদের দ্রুত সে দেশের রাজধানী “ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক” করলেও বাবা-মাকে আমাদের বাড়ি ছাড়ার জন্যও রাজি করাতে পারিনি আমি।

অন্যত্র যাওয়ার কথা বলায় বাবা আমাকে বলেছিলেন, “এই বয়সে আমাদের নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট সহ্য করে জনাকীর্ণ শহরগুলোয় যাওয়া, সেখানে প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদার ঘাটতির বিষয়টার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। তাই, তেহরান ছেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য কোনো বিকল্প নয়।”

আমার বাবা-মা দুজনেরই ডায়বেটিস আছে। গত মাসে মায়ের ভার্টিগোর (এক ধরনের রোগ, যাতে মাথা ঘোরাসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়) সমস্যা হওয়ার পর থেকে তিনি বলতে গেলে ঘরেই বন্দি। কেউ সাহায্য না করলে মায়ের পক্ষে হাঁটা-চলা করা সম্ভব নয়।

আমার বাবা দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। একটানা দশ মিটারের বেশি হাঁটতে পারেন না তিনি। তার বেশি হাঁটতে হলে তাকে রাস্তায় থেমে, বিশ্রাম নিয়ে তারপর হাঁটতে হয়।

‘নিজের বাড়িতেই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু হওয়া ভালো’

তবে, আমার বাবা-মাই যে একমাত্র অন্যত্র যেতে রাজি হচ্ছেন না, এমনটা নয়। তেহরান ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চান না অনেকেই।

ইরানের বাসিন্দা এক নারী আমাকে জানিয়েছেন তার অভিভাবকও অন্য কোথাও যেতে চান না। তিনি বলেছিলেন, “আমার বাবা-মা মনে করেন, অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতেই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু হওয়া ভালো।”

“তারা আমাকে বলেছেন, যদি আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয় তাহলে আমরাও এর সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতে চাই।”

আরও এক বাসিন্দা আমাকে ব্যাখ্যা করছিলেন, কেন তেহরান ছেড়ে চলে যাওয়াটা অনেকের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।

ওই নারী আমাকে বলেছিলেন, “আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত। আমাদের পড়শীদের মধ্যে এমন মানুষ রয়েছেন, যারা হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভরশীল।”

যারা থেকে যেতে চেয়েছেন বা থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জন্য এখানে পরিস্থিতি খুবই কঠিন।

খাদ্য ও জ্বালানির অভাব

তেহরানের বেশিরভাগ ক্যাশ মেশিন (এটিএম বা টাকা তোলার ব্যবস্থা রয়েছে এমন মেশিন) খালি হয়ে গিয়েছে। এক নারী আমাকে জানিয়েছেন, তেহরানের প্রতি দশটা দোকানের মধ্যে খোলা আছে মাত্র একটা দোকান।

অন্য একজন বাসিন্দা আমাকে জানিয়েছেন তাদের বাড়ি যে বিল্ডিংয়ে, সেখানে জল নেই। কারণ ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাতের শুরু হওয়ার সময়েই জলের পাইপ ফেটে গিয়েছিল। তারপর, জলের পাইপ সারানোর জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি।

এক ব্যক্তি আমাকে বলছিলেন, “বাড়ির বাচ্চাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এখানে থেকে গিয়েছি- শহরের বেড়ালগুলোর কথা ভেবে, বাড়িগুলোর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। ঈশ্বর চাইলে এর (সংঘর্ষ) শেষ হবে।”

তিনি কথা বলতে বলতে রাস্তায় ঘুরতে থাকা বেড়ালগুলোর দিকে ইশারা করলেন।

তার মতো তেহরানের বহু বাসিন্দাই রাস্তার বেড়ালদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন।

তেহরানে ব্যক্তিগত অর্থায়নে পরিচালিত একটি ‘ক্যাট মিউজিয়াম ও ক্যাফে’ রয়েছে, এটার নাম ‘মিয়াওজিয়াম’।

তেহরানের রাস্তায়ও বহু বেড়াল থাকে এবং এটাও শহরটির পরিচিতির একটা অংশ।

তীব্র যানজট

ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা যা, শুধু তেহরানেই তত সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন। তাই তেহরানের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হলে যে পরিমাণ যানজট সৃষ্টি হতে পারে তা কল্পনা করা খুব একটা কঠিন নয়।

এদিকে, গাড়ির জন্য জ্বালানি বরাদ্দের বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সেই নিয়ম মেনে গাড়ির চালকদের প্রতিদিন ২৫ লিটার করে তেল বরাদ্দ করা হয়েছে।

তেহরান ছেড়ে যারা অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যানজটের কারণে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তাতেই কাটাতে হচ্ছে।

এর মধ্যে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে তাও অনুমান করা যায়।

আমাকে কেউ কেউ বলছিলেন, অর্ধেক রাস্তা যেতেই তার গাড়ির তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল।

অনেকেই শান্ত উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ মাজান্দারান ও গিলানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তেহরান থেকে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে আনুমানিকভাবে তিন থেকে চার ঘণ্টার মতো। কিন্তু গত কয়েকদিনে ওই দূরত্ব যেতে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগছে।

একজন বাসিন্দা আমাকে বলছিলেন, “গত কয়েকদিন ধরে ট্র্যাফিকের দিকে আমরা নজর রাখছিলাম যাতে পিক আওয়ার্স নয় (যে সময় রাস্তায় সাধারণত গাড়ি কম থাকে) এবং যে সময় যানজট কম থাকে, সেই সময় আমরা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবো। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই যানজটেই আটকে পড়েছি।”

“ভীষণ গরম পড়েছে। গাড়ির জন্য বরাদ্দ তেলের মাত্রা বেঁধে দেওয়ার কারণে কেউ গাড়ির এসি চালাতে পারছেন না। কিছু গাড়ি রাস্তাতেই খারাপ হয়েছে বা তেল ফুরিয়ে গেছে। পেট্রোলপাম্পের সামনে লম্বা লাইন যা কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত।”

আর যারা নিজেদের গন্তব্যে কোনোমতে পৌঁছাতে পেড়েছেন, তাদের সামনে অন্য সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে থাকার জন্য বা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই।

এখানেই শেষ নয়, গাড়ি ভাড়া অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল ভাড়া চাওয়া হচ্ছে। আর খাবারের দাম এখন আকাশছোঁয়া।

ট্রাম্পের জন্য বার্তা

ইরানের বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করেন কয়েক দশকের নিপীড়নের পর এখন তাদের রাতারাতি এমন এক যুদ্ধের মাঝে টেনে আনা হয়েছে যার অংশ তারা কখনোই হতে চাননি।

সে কথাই বলেছিলেন তেহরানের এক বাসিন্দা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েল, অথবা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র-এদের কেউই কিন্তু আমাদের নিয়ে চিন্তিত নয়।”

ওই ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, তিনি তেহরানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন, অন্যত্র যেতে রাজি নন।

আরেক নারী আমাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “একটা নিষ্ঠুর শাসনব্যবস্থা যেটা নিজের জনগণের কথা ভাবে না, আর যারা আমাদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে–– এই দু’ইয়ের মাঝে আমরা আটকে পড়েছি।”

তিনি বিশ্বাস করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ার যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন তা শুধু বেসামরিক হতাহতের ন্যায্যতা প্রমাণের একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ওই নারী একটা বার্তা পাঠিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “বিশ্বের আরেক প্রান্তে বসে আপনি বলছেন তেহরান ছেড়ে অন্যত্র সরে যাও। এর মানেটা কী? আপনি শুধু আমরা মরে গেলে বলছে চান- আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম!”

Related Articles

Back to top button