জামালপুর

ব্রহ্মপুত্র নদ ভরাট করে বিএনপি নেতার সড়ক নির্মাণ

স্টাফ রিপোর্টার: জামালপুর শহরের চালাপাড়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা ভরাট করে আড়াআড়িভাবে একটি রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে। মূল নদ থেকে বালু তুলে বিক্রি সহজ করতে ও চরের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করতেই এই রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে এবং নির্মাণাধীন এই পথে বালুবাহী যানবাহন চলাচল করবে-এমনটাই জানান স্থানীয়রা।

ওই বিএনপি নেতার নাম মো.মিজানুর রহমান। তিনি জামালপুর জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। এই রাস্তা নির্মাণ কমিটির  সভাপতি তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়- শহরের পাথালিয়া থেকে পুরোনো ফেরিঘাট এলাকা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র নদের এ শাখা মূল নদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই শাখা নদটি একদম জামালপুর শহর ঘেঁষা। বিভিন্ন সময়ে বর্ষা মৌসুমে নদে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিতো। ফলে ২০১৩ সালে ভাঙনরোধে ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই শাখা নদের ডান তীরে জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরে শহরের যানজট কমাতে ২০২০ সালে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে  এই শাখা নদের তীরঘেঁষে পুরোনো ফেরিঘাট থেকে ফৌজদারি মোড় পর্যন্ত পৌনে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। এই সড়কের চালাপাড়া অংশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর দিয়ে বালু ফেলে এ রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন জানান- বিগত সরকারের আমলেও এই শাখা নদটির বিভিন্ন স্থানে ভরাট করে দখল করা হয়েছে। এই শাখা নদের তমালতলা অংশেও ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করার চেষ্টা হচ্ছে। সেখানেও কিছু মাটি ফেলা হয়েছে। এসব প্রশাসনের নাকের ডগার সামনে হলেও রহস্যজনক কারণে দুই জেলার সীমানা জটিলতার অজুহাতে স্থানীয় প্রশাসন নদটি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়- এই শাখা নদের তীরঘেঁষে পুরোনো ফেরিঘাট থেকে ফৌজদারি মোড় পর্যন্ত সড়কের চালাপাড়া অংশে শহর রক্ষা বাঁধের রেলিং ভেঙে বালু ফেলা হয়েছে। আর নদের দক্ষিণপাশে শেরপুর জেলার চরপক্ষীমারী অংশে ড্রেজার মেশিনের পাইপ বসানো আছে। সেই পাইপ দিয়ে শাখা নদের মধ্যে বালু ফেলা হয়েছে। নদের মধ্যে বালু ফেলে কিছুটা ভরাটও করা আছে। ওই সড়কের ডান পাশ দিয়ে সুন্দর একটি ফুটওভার ছিল। সেখাটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিকেল বেলায় লোকজন এই ফুটওভার দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে থাকেন। ছবি উঠানোর সময় ভরাট কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন ছুঁটে আসেন। তাঁদের মধ্যে একজন রফিক মিয়া। তিনি বলেন, এই রাস্তাটি সবার জন্যেই দরকার। চরের লোকজন যাতায়াত করতে পারেন না। রাস্তাটি কে নির্মাণ করছেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপি নেতা মিজানুর রহমানসহ অনেকেই আছেন।

শহরের চালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা এক নারী বলেন,‘আমার বাড়ির একদম সামনেই বাঁধের রেলিং ভেঙে রাস্তাটি করা হচ্ছে। এই সড়কের নিচ দিয়ে আমার বাড়ির পানি যাওয়ার পাইপও আছে। তাঁরা পাইপের মুখসহ ভরাট করে ফেলেছে। তাঁদের এভাবে রাস্তা নির্মাণে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কোনো কথায় শুনেননি। হঠাৎ এমন রাস্তা কেনো? এমন কৌতুহল থেকে খুঁজ নিয়ে জানতে পারি-এই রাস্তা দিয়ে তাঁরা নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করবেন। এই রাস্তা বন্ধে আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানাবো।’

জামালপুরের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম  বলেন-‘জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধ ও রেলিং ভেঙে ট্রাক দিয়ে মাটি ভরাট করছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। অথচ জামালপুর, শেরপুর জেলার সীমানা জটিলতা দেখিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। নদী ভরাট করে অপ্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণ করা হলে, নদের সর্বনাশের পাশাপাশি জামালপুর শহর জলাবদ্ধতার ভয়াবহ রুপ নিবে। পানিনিষ্কাশনের একমাত্র পুরাতন নদের মাঝখান দিয়ে সড়ক নির্মান বন্ধ করার জন্য জামালপুর ও শেরপুর জেলা প্রশাসনের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন যদি অপরাগ হয় তাহলে আমরা দুই জেলার বাসিন্দাদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবো।’

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান বলেন-‘ওই স্থানে রাস্তা নির্মাণের খবর পেয়ে, সরেজমিনে দেখে এসেছি। সেখানে যাতে কোনোভাবেই রাস্তা নির্মাণ করা না হই, সেই জন্যে জেলা প্রশাসনকে আমরা চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছি। কারণ জামালপুর শহরের সকল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার একমাত্র ওই শাখা নদটি। ওই শাখা নদ দিয়ে সারা বছর পানি নিষ্কাশন হয়ে থাকে। সেখানে রাস্তা নির্মাণ করা হলে, জামালপুর শহরের অভ্যন্তরীণ জলাবদ্ধতার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। রাস্তাটি যাতে না হই, এই বিষয় নিয়ে আবারও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা হবে।’

মো.মিজানুর রহমান বলেন-‘জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের অনুমতি নিয়েই আমরা রাস্তাটি নির্মাণ করছি। সেখানে আমরা পানি নিষ্কাশনের জন্যে একটি কালভার্ড নির্মাণ করবো। যাতে পানি নিষ্কাশনে কোনো সমস্যা না হই।’ এই রাস্তাটি কি? বালু বিক্রির জন্যে করা হচ্ছে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,‘এই ধরণের কাজের সঙ্গে আমি কখনোই যুক্ত হয়নি। সত্যিকার অর্থে, সেখানে অনেক গরিব মানুষ থাকে। তাঁদের যাতাযাতের সুবিধার্থে এই রাস্তা। সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরাতো-শেরপুর জেলার বাসিন্দা-তাহলে এইখানে আপনি কেনো?-রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়েছেন-এমন প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

জামালপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইউসুপ আলী  বলেন-‘সম্প্রতি এ জেলায় আমি যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানাছিলো না। তবে আপনার কাছে শুনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ম্যাজিস্ট্রেটরা গিয়েছিল। ওই অংশের বেশিরভাগ শেরপুর জেলার মধ্যে পড়েছে। আর ড্রেজান মেশিনও শেরপুর অংশেই। এই কারণে আমি শেরপুরের জেলা প্রশাসককেও বিষয়টি জানিয়েছি। যেটুকু অংশ জামালপুরের সেখানে কোনো ভাবেই রাস্তা নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।’

Related Articles

Back to top button