সময়-অসময়ে ভয়াবহ রূপ নেয় যমুনা
নদী পাড়ের কান্না থামাতে প্রয়োজন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা
শাওন মোল্লা ও হৃদয় আহম্মেদ: সারা দেশে নদী ভাঙন কবলিত যে কয়েকটি জেলা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম জামালপুর। জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটি উপজেলা ঘেষে বয়ে গেছে যমুনা নদী। ১৬ নদ-নদীর এই জেলায় সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয় যমুনা নদীতে। এতে প্রতি বছর নি:স্ব হয় শত শত মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়ে চলে যায় অন্যত্র। নদী গর্ভে বিলীন হয় হাজার হাজার একর ফসলী জমি। এর জন্য জামালপুর হচ্ছে দরিদ্রতম জেলা গুলোর মধ্যে একটি। নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড অস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করে সাময়িক চেষ্টা করলেও আগ্রাসী যমুনার কাছে পরাজিত হতে হয় বারবার। তাই ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের দাবি সকলের। তবে পাউবো বলছে- নদী পাড়ের মানুষের কান্না থামাতে প্রয়োজন দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের খোলাবাড়ি এলাকার ৫৩ বছর বয়সী বিধবা তাজ্জিনা বেগম। যমুনা নদীর পাড়েই ছিলো তার দোচালা ঘর। সম্প্রতি অসময়ের ভাঙনে যমুনা নদীর গর্ভে চলে যায় তার শেষ আশ্রয়স্থলটি। এরপর থেকে প্রচন্ড শীতেও খোলা আকাশের নিচে রয়েছে ৪ বছর আগে স্বামী হারানো এই নারী।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাজ্জিনা বেগম বলেন- ‘এর আগেও যমুনা নদী তিন বার আমার বাড়ি খাইছে। এটা নিয়ে চারবার। স্বামী নাই, সন্তানরাও গরীব। তাদের চিন্তায় তারা বাচে না। এখন আমি কোথায় যায়? অন্য মানুষের বাড়িতে কাজ করে খায়। কিন্তু তারা তো আর থাকতে দিবে না। শেষ বয়সে জমি কিনে ঘর বানানোর টাকা আমার কাছে নাই। আমি এখন নি:স্ব। আমার কোনো ঠিকানা নাই।’
শুধু তাজ্জিনা বেগম নয়, প্রতিনিয়ত যমুনার ভাঙনে নি:স্ব হচ্ছে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা। বর্ষা মৌসুম, শুষ্ক মৌসুমসহ সময়-অসময়ে যমুনা নদীর বামতীরে দেখা দেয় ভাঙন।
জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে- ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় থেকে যমুনা নদীতে শুরু হয় ভাঙন। সেই সময় ইসলামপুরে বড় ধরনের নদী ভাঙন দেখা দেয়। দেওয়ানগঞ্জে ভাঙন শুরু হয় ২০০২ সালের পর থেকে। ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যমুনা নদীর ভাঙনের কারনে জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর ও সরিষাবাড়ী উপজেলার নয় ইউনিয়নের দশ হাজার পচাঁনব্বই জন মানুষ স্থানান্তর হয়েছে।
জেলার ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল এলাকার বাসিন্দা আসাদুল্লাহ ফারাজী মোবাইল ফোনে বলেন-‘যমুনা নদীতে আমার বাড়ি ঘর ডুবেছে ২০১৫ সালে। এরপর থেকে আমরা ঢাকাতে থাকি। এই জায়গায় আমি একা নয়। আমাদের জামালপুরের অনেক বাসিন্দা আছে। যাদের বাড়ি-ঘর, শেষ ঠিকানা আজ নদীর বুকে। তারা ঢাকাতে রিকসা চালাচ্ছে, বাসা-বাড়িতে কাজ করছে।’
গত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার জেলায় ৬০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করে। সরকারের তিন মেয়াদে ভাঙন রোধে যমুনার বাম তীরের ২৮ কিলোমিটার স্থায়ী বাধ নির্মান করা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে এই পরিমান কাজ খুবই কম বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
গত বছর মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের পাকরুল গ্রামের যমুনা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৮০ বছর বয়সী সিদ্দিক শেখ। তার ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি বসবাস করছেন পাশের গ্রামে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিদ্দিক শেখ বলেন- ‘আমাদের এলাকার মেলা উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ কালভার্ট সবই হইছে। খালি পাইলিং হয় নাই। পাইলিংটা হইলে আজকে আমারে মাইনসের জমিতে ঘর বানায়ে থাকা লাগতো না। নদী ভাঙনের জন্য যখন হাজার হাজার মানুষের জীবন বাচতাছে না। তখন কোটি কোটি টাকা খরচ কইরে শহরে ফ্লাইওভার, সাংস্কৃতিক পল্লী করা বিলাসীতা ছাড়া আর কিছুই না।’

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা যায়- জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু হয়ে ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলায় যমুনা নদীর পথ রয়েছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বর্তমানে ভাঙন প্রবন রয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
ভাঙন ঝুকিতে রয়েছে জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের যমুনা নদীর পাড়ে অবস্থিত নলসন্ধা, ডাকাতিয়া মেন্দা ও কাঠালতলা গ্রাম। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে সেখানকার শত শত বাসিন্দা। নলসন্ধা গ্রামের ষাটোর্ধ ইন্তেজ আলী বলেন-‘আমরা গরীব মানুষ বলেই এই নদীর পাড়ে থাকি। আমাদের তো আর কোনো ঠিকানা নেই। এখন এটা যদি ভাঙ্গে। আমাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নাই। আমরা একদম নি:স্ব হয়ে যাবো।’
জেলা নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন- ‘জামালপুর জেলার প্রধান সমস্যা নদী ভাঙন। এই নদী ভাঙনকে কেন্দ্র করেই বেকারত্ব, বাল্য বিয়ে, মাদকসহ সকল ধরনের সমস্যার উৎপত্তি। তাই আগামীতে যে সরকারই আসুক। সবার আগে নদী ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত। এই সমস্যার সমাধান হলে টিকে থাকবে নদী পাড়ের মানুষের অস্তিত্ব, বেচে থাকবে তারা।’
এসব বিষয়ে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান বলেন- ‘কোন এলাকায় নদী ভাঙনের খবর পেলে দ্রুত সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করি। প্রথমে ইমারজেন্সী বেসিসে কাজ করা হয়। এরপর প্রকল্পে গ্রহনের জন্য সমীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ডাটাবেজ তৈরী করা হয়। প্রকল্প অনুমোদনের জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার আমরা তাই করি।’
নকিবুজ্জামান খান আরো বলেন- ‘যমুনা নদীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মতো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলে মোটামুটি স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হতে পারে। একসাথে এতো অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। আমরা ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করছি। নদী ভাঙন রোধে আমাদের পদক্ষেপ অব্যাহত আছে।’




